[সাল ২০৮০]
লেখক: সোহানুর রহমান।
বি. এ. এফ শাহীন কলেজ
মধ্যরাতের তৃতীয় প্রহর পেরিয়ে, পূর্বাকাশ ফর্সা হয়ে উঠেছে। মুয়াজ্জিনের কন্ঠে আযানটাও ভেসে উঠল। নিত্যদিনের মত নামাজ পড়ে কোরান শরিফ নিয়ে বসলাম। কতক্ষণ কেটে গেল জানি না, হঠাৎ বউমা ডেকে উঠল, ‘বাবা, নাস্তা তৈরি।‘ গায়ে শক্তি নেই আর, চোখের আলোও নিভু নিভু। নাস্তা সেরে নিলাম পরিবারের সাথে। আমার ছোট্ট দাদুভাইটা চলে গেল ভার্চুয়াল অনলাইন ক্লাসে। আমিও আমার রুমে এসে বসলাম। জীবন এখন প্রকৃতি বিবর্জিত, কৃত্রিমতায় ঠাসা। সবকিছুতেই এখন বিজ্ঞান তথা যন্ত্রের রাজত্ব। গড়ে উঠেছে শত শত তলা বিশিষ্ট সুপ্রাচীর ভবন। এসব কিছুর মধ্যেও অতীত জীবনের কথা, পুরোনো স্মৃতি কখনো কখনো উঁকি দেয় চুপিসারে। হঠাৎ কি জানি ঝঞ্ঝন করে উঠল আমার স্মৃতি ঘরটায়। ঘরটার নাম রেখেছি টাইমক্যাপ্সুল, ওতে আমার স্কুলজীবন, কলেজজীবনের সব স্মৃতি, হাসি, কান্না, দুঃখ, সুখ, সবকিছু জমা রাখা। গিয়ে দেখি, আমার কলেজের গ্রুপফটো এলবামটা পড়ে ভেঙে গেছে। যত্ন করে তুলে আলমারির ভিতরে রেখে দিলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম আমার কলেজ জীবনের ডাইরিটা ঐ আলমারিতে এককোণায় পড়েছিল। এক অদ্ভুত অনুভূতি, ভালো লাগার মুহূর্তগুলো চোখের সামনে আলোর ঝলকানি দিয়ে গেল। যাক, টাইম ক্যাপসুল রুম টা বন্ধ করে ডাইরিটা নিয়ে বারান্দায় চলে আসলাম। দু-এক পাতা উল্টাই, কত যে স্মৃতি টুকে টুকে রেখেছি তা আর বলে বোঝাতে পারব না। পড়তে পড়তে হারিয়ে গেলাম অন্য এক জগতে, শিরদাড়া বেয়ে শিহরণ খেলে যায়। পুরোনো বন্ধু সায়ক, সারুয়ার, রফিকে নিয়ে যে কত কথা যে লিখে রেখেছি। হাসি-ঠাট্টা, মজার ঘটনা গুলো সব জমা এই ডাইরিতে। নিজেকে প্রশ্ন করলাম কেমন আছে সবাই?
[বলে রাখি ,”চাকরিসূত্রে জন্মভূমি সেরে পাড়ি জমিয়েছিলাম ভিনদেশে,” তাই কারো সাথে যোগাযোগ নেই আর।]
ডাইরিটা পড়তে পড়তে দেখলাম, এককোনে আমার ফেসবুক পাসওয়ার্ডটা লিখে রাখা। বার্ধক্য সব কেড়ে নিয়েছে, মনে রাখার শক্তি নেই কবে থেকেই। পাসওয়ার্ড ভুলে যাওয়ায় ফেসবুকে ঢোকা হয়নি বহু যুগদুয়েক বছর ধরে। তাই মনে মনে খুব খুশি হলাম।
যাক কথাই আসি, পড়া বাদদিয়ে ল্যাপটাওপ্টা নিয়ে ফেসবুকে লগ ইন করতেই দেখি লাখের বেশি নোটিফিকেশন, হাজারদশকে বেশি মেসেজ। নোটিফিকেশনের দিকে তেমন নজর না দিয়ে আমি মেসেঞ্জারে গেলাম। ঢুকে দেখি কিছু কাকতালীয় মেসেজ, প্রাণাধিক প্রিয় বন্ধু সায়ক এর মেসেজ।
মেসেজটি ছিল এমন, “কি রে কেমন আছিস, কোথায় আছিস? দিনকাল ভালো যাচ্ছে না রে, শরীরটা কেমন যেন হয়ে গেছে। বোধহয় আর বেশি দিন বাঁচব না। তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।“ লক্ষ্য করে দেখলাম মেসেজটি প্রায় দশ বছর আগের। একটু পর খোঁজ নিয়ে দেখি বন্ধু আমার পাঁচ বছর আগেই মারা গেছে আমার অজানাতে! হায়!
অন্যদের খুজতে গিয়ে দেখলাম, বেশিরভাগই আমাকে ছেড়ে পাড়ি দিয়েছে পরলোকে। মনের অজান্তে দুই চোখ বেয়ে টপটপ করে অশ্রুকণা ঝরে পড়তে শুরু করল। মুহুর্তেই একদম ভেঙে পড়লাম। খুব ইচ্ছে করছিল তাদের বলি, “আমি বেশ আছি রে, তোরা কেমন আছিস? পরিবারের সবাই কেমন আছে?”
কিন্তু নাহ, নেই, তারা আর নেই। চলে গেছে। ছকবাঁধা সময় সল্পতার এ জীবন ছেড়ে তারা পারি দিয়েছে ভিন্ন এক জগতে। হৃদয়ের অন্তরালে ফেলে গেছে তাদের সাথে কাটানো প্রত্যেক মধুর মুহুর্তগুলো।
হয়তবা আজ, কাল বা পরশু আমাকেও পাড়ি দিতে হবে অজানা এক পথের উদ্দেশ্যে। হয়ত আবার আমাদের দেখা হবে অজানা ঐঅসীমে প্রান্তে।
শুধু পড়ে থাকবে আমাদের এই রেখে যাওয়া স্মৃতিগুলোই। অজানা পথিকের বেশে হয়তবা কেউ “টুকটুক,টুকটুক ,” করে নাড়াবে স্মৃতির এই দরজায়। নিছক একটি বার্তার অপেক্ষায় বসে থাকবে ক্ষণিকের জন্যে, হয়ত চোখের জল ফেলবে আমার কথা ভেবে। মুখ ফুটেও বলতে পারব না তাদের , ” নাহ ,নেই আমি, তোমাদের ছেড়ে চলে গেছি অনেক অনেক দূরে, পাড়ি দিয়েছি অজানা এক অসীম প্রান্তে।
[পরিসমাপ্তি]